ফার্নেস অয়েলের সংকটে আছে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। ডলারের সরবরাহে ঘাটতি থাকায় ফার্নেস অয়েল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। দেশের ২৭ ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রে এই তেল ব্যবহার করা হয়।
জ্বালানি তেল আমদানি করা রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বলছে, বিপিসির কাছে বর্তমানে ফার্নেস তেলের মজুত আছে এক সপ্তাহের। তবে চলতি মাসের শেষ দিকে ফার্নেস অয়েলের নতুন দুটি জাহাজ আসার কথা রয়েছে। সেগুলো না আসা পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হবে। ফলে বাড়তে পারে লোডশেডিং।
প্রতিদিন গড়ে চার হাজার টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা আছে বিপিসির কাছে। এরমধ্যে দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) থেকে দিনে এক হাজার ১০০ টন করে ফার্নেস অয়েল পাওয়া যায়। বাকিটার যোগান আসে আমদানি করা তেল থেকে।
বিপিসি বলছে, গতকাল ১৪ জুন পর্যন্ত বিপিসির কাছে ফার্নেস অয়েলের মজুত ১৮ হাজার টন। দৈনিক চাহিদা অনুযায়ী এই মজুত দিয়ে ছয়দিন চলবে। বিপিসি জানায়, সাধারণত এক মাসের জন্য ফার্নেস অয়েলের মজুত রাখে তারা।
বিপিসি থেকে আরও জানানো হয়েছে, ২২ জুনের মধ্যে ২৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল নিয়ে একটি কার্গো জাহাজ দেশে আসার কথা। এটি আসার কথা ছিল ১২ জুন। জাহাজটি বন্দরে পৌঁছার পর বিদ্যুৎকেন্দ্রে তেল সরবরাহ করতে আরও কমপক্ষে আটদিন সময় লাগবে। তবে ২৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল নিয়ে ২৬ জুনের মধ্যে আরও একটি জাহাজ দেশে আসার কথা রয়েছে।
তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ডিজেলচালিত আটটি কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৯৮৬ মেগাওয়াট। খরচ কমাতে এগুলো বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। আর ফার্নেস তেলচালিত ৬৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা আছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট। কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমায় সর্বোচ্চ চাহিদার সময় রাতে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটও উৎপাদন করা হয়েছে জ্বালানি তেল থেকে। তবে বর্তমানে তা আর সম্ভব হবে না।
বছরে প্রায় ৬০ লাখ টন বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল আমদানি করে বিপিসি। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই ডিজেল। মাসে এখনো ১০ থেকে ১২টি ডিজেল কার্গো আসছে। ৩০ দিনের চাহিদার সমপরিমাণ ডিজেল মজুত আছে। আর ফার্নেস অয়েলের কার্গো আসছে মাসে একটি বা দুটি। বছরে ৫০ লাখ টনের বেশি ফার্নেস অয়েলের প্রয়োজন হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এরমধ্যে ৪৫ লাখ টন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নিজেরা আমদানি করত।
যদিও গত বছর থেকে আমদানি কমিয়েছে তারা। এতে বাড়তি চাহিদা পাচ্ছে বিপিসি। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) সাড়ে আট লাখ টনের বেশি চাহিদা এসেছে। আগামী অর্থবছরে এ চাহিদা ১০ লাখ টনের বেশি হবে। এ চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে বিপিসি।
জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ব্যাংকের কাছে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও দফায় দফায় বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়েছে। বিপিসির কর্মকর্তা জানান, ১৩ জুন পর্যন্ত জ্বালানি তেলে প্রায় ২১ কোটি ডলার বকেয়া পেড়েছে। বকেয়ার কারণে সরবরাহকারীদের কেউ কেউ জ্বালানি তেল দিতে রাজি হচ্ছে না। কেউ কেউ ক্রয়াদেশ বাতিল করে দিচ্ছে, কেউ সময় পেছাচ্ছে।
বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলেন, ‘প্রথম জাহাজ আসার পরও কিছুটা চাপ থাকবে, এটা ঠিক। তবে এ মাসে দ্বিতীয় কার্গো জাহাজ আসার পর চাপ কমবে। আর আগামী বছরের জন্য পিডিবি এখনো মাসওয়ারি চাহিদা দেয়নি। এটি দিলে সে অনুসারে আমদানির পরিকল্পনা করা হবে।’
বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নিয়মিত তাদের বিদ্যুৎ বিক্রির টাকা পাচ্ছে না। পিডিবির কাছে তাদের পাওনা ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এতে তারা ব্যাংকের বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না। আর ব্যাংক নতুন করে ঋণপত্র খুলতে রাজিও হচ্ছে না। ফলে নিজেদের বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর জন্য ফার্নেস অয়েল আমদানি পিছিয়ে পড়ছে।
পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার-সংকটে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে কয়লা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। কয়লার মজুত শেষ হয়ে পড়ায় আপাতত বন্ধ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। সক্ষমতার অর্ধেক উৎপাদন করছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহের চার দিনের মাথায় বন্ধ হয়েছে বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। কয়লার অভাব থাকায় জ্বালানি তেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে পিডিবি। এখন এটিও কমছে।
মাঝে বৃষ্টির কারণে পাঁচ দিন তাপমাত্রা কম থাকায় তেমন লোডশেডিং করতে হয়নি। গত মঙ্গলবার থেকে লোডশেডিং বাড়তে শুরু করেছে। ওই দিন মধ্যরাতে দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেল চারটায় সারা দেশে লোডশেডিং হয়েছে এক হাজার ৯০৫ মেগাওয়াট। তবে ঢাকায় এখনো লোডশেডিং শুরু হয়নি।