‘আমার বাজানে এবার ক্ষেতে তরমুজ দেছে, তরমুজ ভাল হইলে বেইচা আমাগো লেহাপড়ার পিছনে খরচ করতে পারবে। সামনে আমাদের বড়ই সুখের সময়।’ ক’দিন আগে বরগুনা সদরের মাঝের চর গ্রামের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মারুফা আক্তার এভাবেই আশার কথাই জানিয়েছিল। কিন্তু বরগুনাসহ উপকূলীয় এলাকাগুলোতে কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ মারুফার মতো অনেকের হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অধিক মুনাফারা আশায় এবছরও কৃষকরা আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে তরমুজ চাষে ব্যস্ত ছিলেন। অনেকে ইতোমধ্যেই আগাম তরমুজ চাষ করে বেশ লাভবানও হয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টিতে কৃষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এবছরই প্রথম তরমুজ যাবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এতে উপকূলের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু জমি থেকে তরমুজ ওঠার আগে এমন লাগাতার বর্ষণে হতাশ বরগুনার তরমুজ চাষী ও ব্যবসায়ীরা।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, গত পাঁচ-ছয়দিন উপকূলে গড়ে ২০-৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরমধ্যে একদিন শিলা বৃষ্টিও হয়েছে। শিলা বৃষ্টিতে তরমুজসহ অন্যান্য ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।
বরগুনা সদরের আট নম্বর সদর ইউনিয়নের মো: সেলিম মৃধা জানান, ‘এ বছর আমি ২৬ একর জমিতে তরমুজের আবাদ করেছি, কিন্তু এই বৃষ্টিতে ক্ষেতে যেভাবে পানি আটকে গেছে তাতে খরচের টাকা ক্ষেত থেকে উঠানো দায় হয়ে যাবে।
সদরের নয় নম্বর বালিয়াতলী ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান জানান, আমি এ বছর তিন একর জায়গায় তরমুজের চাষ দেছেলাম। সরকারি ভাতার টাকা সবই তরমুজ ক্ষেতের পিছেই শেষ করছি। এরকম বৃষ্টি হইলে চোখে আন্ধার দেহা ছাড়া উপায় নাই।’
শিলাবৃষ্টির কারণে ইতোমধ্যেই একরের পর একর জমির তরমুজ নষ্ট হয়েছে। চাষীরা বলছেন, তাদের অনেক তরমুজেই শিলার দাগ লেগে আছে এবং সেখান থেকে পচন ধরছে। অন্যদিকে, জমিতে পানি আটকে থাকায় অনেকের তরমুজের চারাই ভেসে রয়েছে। ফলে তরমুজ গাছের গোড়া পচে গাছসহ ফলটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বরগুনা সদরের তরমুজ চাষী আবু হানিফ বলেন, ‘এনজিও থেকে চড়া সুদে চার লাখ টাকা ঋণ নিয়া তিন হেক্টর জমিতে তরমুজ দিছি। কিন্তু যে বৃষ্টি হইছে, সাথে এই ঋণ শোধ করমু ক্যামনে হেই চিন্তায় হুশ জ্ঞান নাই।’
শুধু বরগুনা সদরই নয় আমতলী, তালতলীসহ জেলার সকল উপজেলার চাষীদের একই দশা। এখন সকল তরমুজ চাষী রাতদিন ব্যস্ত মাঠে সেচের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন নিয়ে। অনেকের জমিতে পানি এমনভাবে আটকে আছে যেগুলো নিষ্কাশন হতে হতে তরমুজ চারা পচে যাবে। অনেকে আবার বৃষ্টি পানি নিষ্কাশন শেষে জমিতে কীটনাশক ও পচনরোধক ওষুধ প্রয়োগ করছেন।
আমতলী উপজেলা তরমুজ চাষী মো. ফারুক জানান, এই বৃষ্টি আর ১০-১৫ দিন পরে হলেও তার আগে কয়েক চালান তরমুজ ঢাকায় পাঠানো যেত। কিন্তু বৃষ্টি না থামলে আমরা ভোগান্তির শিকার হবো।
এবারের তরমুজ চাষকে কেন্দ্র করে প্রান্তিক পর্যায়ে গড়ে উঠেছিল সার ও কীটনাশকের দোকান। সেসব দোকানে এখন শুধু পচনরোধক ওষুধ বিক্রির হিড়িক লেগেছে।
বরগুনা সদরের মাওয়া ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী গোলাম কিবরিয়া জানান, বৃষ্টির কয়েকদিন ধরে তরমুজ চাষীরা শুধু সিরাজিন, জি-মেটালিক্স ওষুধ কিনছেন। এই ওষুধ প্রয়োগে তরমুজের পচনরোধ হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবু সৈয়দ মো. জোবায়দুল আলম জানান, তরমুজ চাষীদের জন্য আমাদের দরজা সব সময় খোলা। ইতোমধ্যেই কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে আমাদের কৃষি অফিসের লোকজনও তরমুজ ক্ষেতে ছুটছেন। ভারী বর্ষায় তরমুজের পচনরোধে কৃষকদের করণীয় বিষয় এবং এ সময়ে ক্ষেতে কী ধরনের ওষুধ দেওয়া যায় সেটা আমাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োগ করলে কৃষকরা বড় রকমের ক্ষতির সম্মুখীন হবেন না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, এবছর বরগুনায় প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। এবছর উৎপাদিত তরমুজ আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকার বেশি বাজারমূল্যে বিক্রি হতে পারে। উপকূলীয় মাটি ও আবহাওয়া তরমুজ চাষের উপযোগী হওয়ায় ক্রমশই এই অঞ্চলে তরমুজ চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফার আশায় উপকূলের কৃষকরা ব্যাপকভাবে ঝুঁকছেন তরমুজ চাষে। একই সাথে তরুণ উদ্যোক্তারাও আশার আলো খুঁজে পেয়েছেন তরমুজ চাষে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আরও জানায়, গত বছর বরগুনা জেলায় প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে। যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত তরমুজ চাষীদের একটা তালিকা করে কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে যাতে কৃষকরা নূন্যতম হলেও ক্ষতিপূরণ পান।