বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, লেখক, বুদ্ধিজীবি, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ডাঃ এসএ মালেক মৃত্যুবরণ করেছেন। ইন্না লিল্লাহহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন।মঙ্গলবার (০৬ ডিসেম্বর) রাত ১১.১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তিনি ২ ছেলে ২ মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়াও আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন, বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।
১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণ করেন ডাঃ এস এ মালেক। ডাঃ এসএ মালেক ছাত্রজীবন থেকেই রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন এবং আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতেন। হাইস্কুলে পড়া অবস্থায় ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এরপর বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর ১৯৬৬ সালের ছয় দফা ও ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যূত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রচারাভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন।
বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণে বঙ্গবন্ধুর সহচর ছিলেন এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ডাঃ এসএ মালেক শুধু সম্মুখ সমরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করেননি তিনি মুজিবনগর সরকারের ফরিদপুর জেলার প্রশাসকও ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ গোপনে ডাঃ এসএ মালেক অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ডাঃ এসএ মালেক ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর ওই অঞ্চল মুক্ত করেন এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে ৮ থিয়েটার রোড, কলকাতায় সাক্ষাৎ করেন ডাঃ এসএ মালেক। তার সঙ্গে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরও। তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশনা অনুযায়ী মেজর জলিল নিয়োগপত্র ইস্যু করেন ডাঃ এসএ মালেককে ৯ নং সেক্টরের অধীনে মুজিবনগর সরকারের ফরিদপুর মহাকুমার প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। ওই নিয়োাগপত্রে তার নাম লেখা হয় ক্যাপ্টেন হালিম। তার নাম যদি ‘ক্যাপ্টেন হালিম’ লেখা না হতো তাহলে যখন তিনি ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করার সময় তাকে হত্যা করা হতো।
তিনি ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা, বোয়ালমারী, কাশিয়াানী, মুকসেদপুরসহ পাঁচটি থানা স্বাধীন করেন। মুক্তাঞ্চলের প্রশাসক হিসেবে থানা সদরে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
গোপালগঞ্জ সাব-ডিভিশন সদরে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার আট দিন পূর্বে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ৮ই ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকারের পূর্ণ প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেন গোপালগঞ্জ মহাকুমা শহরে।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ এসএ মালেক ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ও তাঁর পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে হত্যার পর তৎকালীন সরকার তাঁকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল। ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর রক্তক্ষরণ থেকে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা জার্মানী থেকে ভারতে এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। ডা. এসএ মালেকও ওই সময় ভারতে ছিলেন। দেশে ফিরে এসে তিনি আর অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা চর্চা বাদ দিয়ে নিজেকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে গড়ে তোলেন।
ডা. এস এ মালেক পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর যখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তখন সেখানে একজন ভারতীয় হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক তাঁর বুকে অস্বস্তির জন্য জন্য জিহ্বায় দুই ফোঁটা ওষুধ খেতে দিয়েছিলেন। সেই দুই ফোঁটা ওষুধে নিমেষেই তাঁর বহু বছরের বুকে অস্বস্তির ভাব দূর হয়। তিনি অভিভূত হন এবং তাঁকে তখন থেকেই ওই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা আকৃষ্ট করে। তাঁকে ওই হোমিওপ্যাথ চিকিৎসকের কাছে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন তখন ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনা।
ডাঃ এসএ মালেক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর ১ নম্বর সদস্য। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি নিয়মিত লিখালিখি করতেন। ১০ হাজারের উপর ইংরেজিতে নিবন্ধ/মতামত এবং প্রায় ৩০ হাজারের মতো বাংলায় নিবন্ধ/মতামত লিখেছেন যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।