ইউরোপে যুদ্ধ ও শীতের অনিশ্চিত যাত্রা

এক অনিশ্চিত শীতকাল ইউরোপের দরজায় কড়া নাড়ছে। টালমাটাল বৃটিশ শাসন সঁপে দিতে হয়েছে এক তরুণ ভারতীয় বংশোধরের হাতে। অঘটন-ঘটন পটিয়সী ন্যাটোর ভূমিকায় চলছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। সজিব সেন লিখেছেন ইউরোপ নিয়ে তার এই মুহূর্তের ভাবনা।

শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা। কবি ভাস্কর চক্রবর্তী শীতকালের জন্য উন্মুখ হয়ে লিখেছিলেন। লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডার লিখেছিলেন ‘দ্য লং উইন্টার’, ইউরোপ কি দীর্ঘ শীতকালের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে, নাকি শীত নামার আতঙ্কে ভুগছে? জানতে গত সপ্তাহে এক ইউরোপিয়ান বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম, জানতে চাইলাম তোমাদের ওখানে ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে নাকি? বললো, ‘না এখন ওয়েদার খুব ভালো তবে উইন্টার ইজ কামিং’। সামনের শীত যে সব ইউরোপিয়ানদের জন্য বিশেষ দুশ্চিতার তা প্রায় সবাই এখন জানে এবং তার জন্য কমবেশি প্রস্তুতিও নিচ্ছে। সামর্থ্য অনুযায়ী প্রস্তুতির ভিন্নতা থাকলেও এই শীতকালকে কঠোর মনে হবার কারণ সবার জন্যই এক, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ’!

এই যুদ্ধে রাশিয়ার উপর অসংখ্য নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পরে, রাশিয়া পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইউরোপের সবচেয়ে দুর্বল জায়গাতে, জ্বালানি খাতে! ইউরোপ রাশিয়ার সস্তা জ্বালানির উপর নির্ভরশীল অনেক দশক ধরে। এই জ্বালানি যেমন ইউরোপের ঘর গরম রাখার কাজে লাগে, তেমনি ইউরোপের ভারী শিল্পের প্রাণশক্তি। এই জ্বালানির সহজ বিকল্প নেই। আমেরিকান এলএনজি বিকল্প হতে পারে কিন্তু ইউরোপকে চালাতে পারে এরকম গ্যাস সরবরাহ অবকাঠামো এই মুহূর্তে নেই। তাই কী পরিমাণ কঠোরতা এই শীতে সহ্য করতে হবে তা কেউ ঠিকঠাক বলতে পারছে না।

জ্বালানির সাথে শুধু শীতেরই সম্পর্ক না, জীবনযাত্রার সব কিছুর ব্যয় জ্বালানির দামের সাথে ওঠানামা করে। ইনফ্লেশন, ব্যাংক রেট, নতুন বিনিয়োগ, চাকরির বাজার, পেনশন ফান্ড, ইউরোর ভ্যালু, সরকারি বাজেট সবকিছুই কমবেশি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ইউরোজনের অবস্থা এখনো বিপদসীমা পার না করলেও সামান্য পলিসিগত ভুল বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে এবং তা বেশ কয়েক বছরের জন্য, এমন কী দশকের জন্যও হতে পারে!

গ্রেট বৃটেন এর সরাসরি উদাহরণ, লিজ ট্রাসের জনতোষণ পলিসি যে বুমেরাং হয়ে গেল সে কথা সে নিজেই স্বীকার করে পদত্যাগ করেছে। এখন সেখানে এমন অবস্থা যে ইংল্যান্ডের মত নাক উঁচু দেশের রক্ষণশীল দল একজন ভারতীয়র হাতে বিনা নির্বাচনে ক্ষমতা দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চাইছে। ব্রিটেনের রাজনীতিবিদরা জানে মধ্যবর্তী স্থিতিশীলতার জন্য সরকারকে এখন বেশকিছু অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেমন ট্যাক্স বাড়ানো বা পেনশন সুবিধার কাটছাঁট করা। স্বাভাবিকভাবেই এগুলো কেউ করে খলনায়ক হতে চায়না। তবে এত সব করেও যে সরকার টেকানো যাবে তার নিশ্চয়তা নেই! ব্রিটেনের সংবাদপত্র জোরেশোরে তুলে ধরছে আগাম নির্বাচনের কথা। কিন্তু আগাম নির্বাচন কি টেকসই সমাধান আনতে পারবে? আপাতত কেউই জানে না সে উত্তর।

এতো গেল বৃটেনের ডামাডোলের কথা, ইউরোজোনের সাময়িক জোড়াতালির উপায় কী? ফিরে যাই আমার সেই ইউরোপিয়ান বন্ধুর কথায়, তাকে বললাম, ‘তুমি এই শীতকাল কাটাবে কী করে?’, সে বললো ‘তিন-চার ঘন্টার ব্লাকআউটের জন্য সে তার ইলেক্ট্রিক গাড়ির ব্যাটারি ব্যাবহার করবে কিন্তু এর চেয়ে বেশি হলে কী করবে সে জানে না’।

আমার বন্ধু আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো তাই সে এই সমাধান বেছে নিয়েছে কিন্তু ইউরোপের গড় আয়ের মানুষের কাছে ইলেক্ট্রিক কার বা ব্যাকআপ ব্যাটারি সহজলভ্য না। তাদের ভরসা ফায়ারপ্লেস আর কাঠের টুকরোর উপরে, যেভাবে তারা কয়েকযুগ আগে ঘর গরম রাখতো। তাদের সরকার কি আমদানি করা এলএনজি দিয়ে এই শীত উৎরানোর চিন্তা করেছে? বেশি দামী এই গ্যাস কিন্তু ইনফ্ল্যাশন, ব্যাংক রেট, নতুন বিনিয়োগ, চাকরির বাজার, পেনশন ফান্ড, ইউরোর ভ্যালু, সরকারি বাজেট সবকিছুকে বাড়িয়ে দিয়ে পরিস্থিতি অনেক জটিল করে তুলবে। আবার এগুলো ঠিক রেখে পরিস্থিতি মোকাবেলার আপদকালীন সমাধানও দেখা যাচ্ছে না।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট তো বলেই দিয়েছেন, ‘আজ ব্রিটেনের যে অবস্থা সম্ভবত কিছুদিনের মধ্যে আমাদেরও সেই অবস্থা হতে যাচ্ছে।’ তাই ইউরোপিয়ান সরকারগুলো কিছু অজনপ্রিয় কাজ করে হলেও সাময়িক জোড়াতালি দেয়ার চেষ্টা করবে। এই সব কাজের ফলাফল হিসাবে ইউরোপেরও বেশকিছু সরকার পতন বা পরিবর্তন হতে পারে। ইটালির কথা বিবেচনায় নিলে পরিবর্তন ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে! কিন্তু এগুলো কি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান? সমাধান খুঁজতে আমাদের সেই যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকেই তাকাতে হবে। আমার বন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ফলাফল কী হবে? সে বলেছিল, ‘উই ডোন্ট নো!’

সাম্প্রতি ইউক্রেনের কিছু এলাকা পুন:দখল করার পরে অনেকেই আশাবাদী হয়েছিল যে হয়তো ইউক্রেন তার হারানো সকল ভূমি উদ্ধার করবে আর রাশিয়া পরাজিত হবে। কিন্তু যুদ্ধে ইরানে তৈরি ড্রোন আবার সেই ইউক্রেনিয়ান মোমেন্টামকে থামিয়ে দিচ্ছে। হয়তো রাশিয়ানদের পক্ষে মোমেন্টাম তৈরি করতে পারে। আসছে শীতে রাশিয়া যে আবার একটা বড় আক্রমণ করবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত! এরপরও বলা যায় যুদ্ধের ফলাফল এই শীতে আসবে কিনা কেউ জানে না। সবারই চাওয়া যুদ্ধ যেন দ্রুত শেষ হয়। শীতকাল যেন লম্বা না হয়!

যুদ্ধের ফল যখনই আসুক, এটা নিশ্চিত, যুদ্ধের ফলাফল কী হবে সেটাই নির্ধারণ করবে ইউরোপ কোন দিকে যাবে। যুদ্ধে রাশিয়ার জয় মানে শুধু ইউরোপই না সারা দুনিয়া থেকেই আমেরিকা-ইউরোপের প্রভাব কমতে থাকবে। আর ইউক্রেনের জয় মানে রাশিয়া অনেকাংশে চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাবে!

লিখেছেন: সজীব সেন, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কারিগরি উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত।

leave a reply