ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তীব্র গরম আর লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জনজীবন 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গরমের তীব্রতার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিং। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে জনসাধারণের। গরম বাড়ার পর থেকেই জেলাজুড়ে লোডশেডিং বাড়তে শুরু করেছে। গত কয়েকদিন ধরে প্রতি রাতে বিদ্যুৎ থাকছে না। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, জুনের প্রথম সপ্তাহজুড়ে তীব্র দাবদাহ অব্যাহত থাকবে।

গেল সপ্তাহে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার মত বিদ্যুৎবিভ্রাট দেখেছে এই জেলার মানুষ। এ অবস্থায় জেলার গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন মানুষ। বিদ্যুৎ না থাকায় রাতের বেলায় ঠিকমত ঘুমাতে পারছেন না তারা। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধদের। এ অবস্থায় হাসপাতালের রোগীদেরও কষ্ট বেড়েছে। বাড়ছে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি।

এছাড়াও স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানেও। শিক্ষার্থী এবং পরীক্ষার্থীদের পড়াশোনাতেও সমস্যা হচ্ছে। অনলাইনে যারা ফ্রিল্যান্সিং করেন তাদের কাজেও নেমেছে স্থবিরতা।
বিদ্যুৎ ঠিকমত না থাকায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরাও। তীব্র গরমে অনেক ক্রেতা বাজারে আসছেন না।

জেলার কয়েকটি হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় রোগীদের অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। প্রচণ্ড গরমে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে, গরমে ঘামের কারণে রোগীদের শরীরে পানিশূণ্যতা তৈরি হচ্ছে। লোডশেডিং চলাকালে বিকল্প ব্যবস্থার চেষ্টাও চালানো হচ্ছে, তবে জ্বালানির অতিরিক্ত মূল্য ও স্বল্পতায় কুলিয়ে উঠা সম্ভব হচ্ছেনা

জেলা শহরের বাসিন্দা ফ্রিল্যান্সার সাইফুর রহমান বলেন, ‘আমি আপওয়ার্কে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করি, সাধারণত ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ও ডিজিটাল মার্কেটিং আমার কাজ। আমার বায়ার ইউরোপ এবং আমেরিকা মহাদেশের, তাদের সাথে কাজ করতে হয় রাত জেগে। কিন্তু রাতে বিদ্যুৎ না থাকায় ইন্টারনেট থাকেনা। ফলে আমার কাজও ঠিকমত করতে পারিনা। আমি এ সমস্যার সমাধান চাই।’

মাছিহাতা ইউনিয়নের বাসিন্দা মোরছালিন চৌধুরী বলেন, ‘গত মাসের ১০ তারিখ প্রায় ৭ বছর পর আমার ছোট বোন আমেরিকা থেকে তার স্বামী এবং তিন সন্তান নিয়ে দেশে এসেছে। তাদের আসার পর থেকেই দিনে রাতে ব্যাপক লোডশেডিং চলছে, এতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে তারা। বিশেষ করে বাচ্চাগুলো অনেক কষ্ট পোহাচ্ছে, ঠিকমত ঘুমাতে পারছে না, খাওয়া দাওয়া করতে পারছে না। আমার বোনের পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করতে আমার বৃদ্ধা নানীও আমাদের বাড়িতে আছেন, বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছেন তিনি, তীব্র গরমে এই অতিরিক্ত লোডশেডিং এর ফলে তিনিও অনেক কষ্টে আছেন। আমি বাধ্য হয়ে আইপিএস কিনে আনছি, কিন্তু এতেও সমাধান হচ্ছে না। এর দ্রুত একটা সমাধান চাই, অন্তত সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসুক লোডশেডিং।’

আশুগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা শিক্ষক সজীবুর রহমান বলেন, কী বলব বলেন, প্রত্যেকটা মানুষ এ নিয়ে কথা বলছে। আমজনতার কথা তুলে ধরেন, আমরা এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাই।’

বিজয়নগর উপজেলার বাসিন্দা অটোরিকশা চালক হেলাল বলেন, ‘গত পাঁচ-সাতদিন যাবত বিদ্যুৎ থাকে না, রাতে ঘুমাতে পারিনা, সারারাত বাচ্চাদের বাতাস করা লাগে। অটোরিক্সার ব্যাটারি ফুলচার্জ দিতে পারিনা, ঠিকভাবে গাড়িও চালাতে পারি না, ইনকামও কমে গেছে।’

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ কান্তি মজুমদার জানান, ‘আমার এরিয়ায় দিনের বেলার চাহিদা হচ্ছে ২১ থেকে ২২ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যার পরের চাহিদা হচ্ছে ২৪ থেকে ২৫ মেগাওয়াট। যখন গরম বাড়ে তখন মানুষ ফ্যানও চালায় এসিও চালায়, সব জায়গায় চাহিদা বেড়ে যায়। যার ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ থেকে ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে যায়। তবে সন্ধ্যায় আমাদের সরবরাহ বেড়ে যায়, গত সপ্তাহে ১৭ থেকে ১৯ মেগাওয়াট করে পেয়েছি।’

তিনি আরও জানান, উৎপাদন কমে গেলে মাঝে মধ্যে সরবরাহ ৯ থেকে ১০ মেগাওয়াটে নেমে যায়। এটা হচ্ছে যখন জাতীয় গ্রিডে উৎপাদন বেড়ে যায় তখন আমাদের বরাদ্দও বেড়ে যায়। আবার যখন উৎপাদন কমে যায় তখন আমাদের বরাদ্দও কমে যায়। কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বসে গেলে বা বন্ধ হলে জাতীয়ভাবে রেসিও অনুযায়ী বরাদ্দ কমে যায়। আর এমনিতে বর্তমান সময়ে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে।

তিনি আরও জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আগে লোডশেডিংই ছিলনা, আগে শুধুমাত্র টেকনিক্যাল কোন সমস্যা হলে লাইন চেঞ্জ করতে, ট্রান্সমিটার পরিবর্তন করতে লোডশেডিং হতো, সেক্ষেত্রে আমরা মাইকিং করে আগেই জানিয়ে দিতাম। আর ইমার্জেন্সির সময় মাইকিং করতে পারতাম না, দেখা গেল এক ঘন্টা বা দুই ঘন্টা বন্ধ থাকবে তখন লোকালি কয়েকজনকে জানিয়ে দিতাম। এটা হচ্ছে গত বছর থেকে জ্বালানি সংকট এবং বৈশ্বিক অনেক কারণে উৎপাদন ও সরবরাহ কমে যাওয়ায় কিছুটা লোডশেডিং দিতে হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী মোঃ আক্তার হোসেন বলেন, আমরা যা বিদ্যুৎ পাই সে অনুযায়ী ডিস্ট্রিবিউশন করি। দিনের বেলা ৭০ থেকে ৮০ মেগাওয়াট সরবরাহ পাচ্ছি এবং রাতের বেলা ১১০ থেকে ১২০ মেগাওয়াট। পুরো জেলাজুড়ে দিনের বেলায় চাহিদা ১০০ থেকে ১১০ মেগাওয়াট থাকে এবং রাতের বেলা ১৫০ থেকে ১৬০ মেগাওয়াট থাকে। এখন গরম বাড়ায় চাহিদাও অনেক বেড়ে গেছে, ফলে লোডশেডিং বেড়েছে। তবে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে।

আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ খুরশেদ আলম জানান, আমাদের যে চাহিদা তীব্র দাবদাহের কারণে আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। আগে দিনের বেলায় ২০ থেকে ২২ মেগাওয়াট চাহিদা ছিল সেটা এখন বেড়ে ২৭ থেকে ২৮ মেগাওয়াট পর্যন্ত হয়েছে। সেক্ষেত্রে আমরা সরবরাহ পাচ্ছি দিনের বেলা সর্বসাকুল্যে ২২ থেকে ২৩ মেগাওয়াট এর মতো। তবে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমরা চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।

leave a reply

Reendex

Must see news