দেশে অনেক উদ্যোক্তা রয়েছেন, যারা নিজ নিজ উদ্যোগের মাধ্যমে সফল হয়েছেন। এমন উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণার গল্পগুলো আমরা পাঠকদের জানাতে চাই। আজ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও তরুণ উদ্যোক্তা মাহাবুব মোর্শেদের গল্প থাকছে আপনাদের জন্য। মাহাবুব মোর্শেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মৌ দাস।
মৌ দাস: উদ্যোক্তা হিসেবে শুরুর অভিজ্ঞতা কেমন?
মাহাবুব মোর্শেদ: শুরুর অভিজ্ঞতাটা খুব বেশি ভালো না। করোনার মধ্যে শুরু করি, তখন খুব খারাপ অবস্থা ছিল। ব্যবসা শুরু করি কিন্তু ক্রেতা খুব কম ছিল। করোনায় মানুষ বের হতো না তখন খুব মন খারাপ হতো। এত টাকা বিনিয়োগ করলাম কিন্তু ক্রেতা নেই, ব্যবসা ভালো চলছে না। তখন ভাবতে থাকি কী করি, কী করা যায়। দোকান খুলি, বন্ধ করি, খুব খারাপ লাগা কাজ করত। এরমধ্যে দোকান রাস্তার কাছে হওয়ায় রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়। দোকান ভেঙে দিল আবার একটা খারাপ অবস্থায় পড়লাম। আবার নতুন করে দোকান নিলাম। দোকান ভালো চলছিল না, তারপরও আশা ছাড়িনি, দেখতে থাকলাম কী হয়। তবে দোকান সরিয়ে নেওয়ার পর একটু আশার আলো দেখতে পেলাম। পার্কের মোড়ের যে অস্থায়ী ভ্রাম্যমাণ দোকান ছিল সেগুলো তুলে দিল। ওই দোকানগুলো ভাঙার পর মানুষ এদিকে আসতে শুরু করল। এরপর থেকে মানুষ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলো। এরপর আগের অবস্থান থেকে ব্যবসা কিছুটা বাড়তে থাকলো। আবার আরেকটা সমস্যা হয়ে গেলো ২/৩ মাস পর আমার দোকানের পাশে লাইভ পিৎজার দোকান দিল। আমাকে তখন আবার দোকান মালিক আমার দোকান সরিয়ে দিয়ে একপাশে করে দিল এবং তাদের বসার ব্যবস্থা করে দিল। দোকান নিয়ে আবার সরে আসলাম। জায়গার মালিক বলেছিল যদি এখানে থেকে না সরে যাও তবে দোকান ছেড়ে দাও। আর নাহলে পাশের দোকানে যাও। সবমিলে বললাম দোকান ছেড়ে দিব। তারপর ভাবতে লাগলাম যদি দোকান ছেড়ে দিই তাহলে তো অনেক টাকা লস হয়ে যাবে। তারপর চিন্তা করে মালিকের সাথে কথা বললাম এবং দোকান সরিয়ে দিলাম। প্রথমে আমি ভাজাপোড়া বিক্রি করেছি, পরে টি এন্ড কফিবার এর নাইম ভাই আমাকে বিরিয়ানি যুক্ত করতে বলেন। আমি তো নুডুলস, পিয়াজু, বার্গার স্যান্ডউইচ বিক্রি করছি। সবাই খাবার পছন্দ করছে। এরপর এক ভাই বুদ্ধি দিল অনলাইনে কিছু করতে। এরপর একদিন অনলাইনে একটা পোস্ট দিই রংপুর ফুডবাজ খাবারের গ্রুপে এরপর থেকে ব্যবসা বাড়তে থাকে। আল্লাহর রহমতে এখন ভালো ব্যবসা হয়।
মৌ দাস: স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন মাথায় এলো কীভাবে?
মাহাবুব মোর্শেদ: ব্যবসাটা আসলে স্বনির্ভর হওয়া নিয়ে শুরু না। করোনার সময় একটা প্রজেক্ট এ কাজ করার সময় কিছু টাকা হলো। তারপর একটা চিন্তা আসলো এমন একটা প্লাটফর্ম দাঁড় করাব যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু করতে পারি। সেইসাথে স্ব-নির্ভর হতে পারি। এছাড়াও একটা শিক্ষার্থীবান্ধব চিন্তা ছিল কম দামে কীভাবে খাবার সার্ভ করা যায় এই লক্ষ্য নিয়ে আমার এই উদ্যোগ গ্রহণ করা বা রেস্টুরেন্টের ব্যবসা শুরু করা
মৌ দাস: উদ্যোক্তা হিসেবে বাধার সন্মুখীন হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে?
মাহাবুব মোর্শেদ: তরুণ উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা অনেকেই পোষণ করেন। তরুণ উদ্যোক্তা হতে গেলে বাধার সম্মুখীন হতে হবে। তবে আমরা দেখি ইউটিউব বা ফেসবুক দেখে অনেক তরুণ তরুণীরা উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। তবে উদ্যোক্তা হতে হলে কিছু ঝুঁকি থাকবে। তরুণ উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকির পরিমাণ খুব বেশি।
তবে তাদের প্রচুর ধৈর্য্য থাকতে হবে। ধৈর্য্য না থাকলে উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব না। আর ব্যবসায় পিছুটান থাকবেই। ব্যবসা তো সব সময় এক রকম চলে না। তবে ধৈর্য্য আর মানসিক মনোবল থাকলে তরুণ উদ্যোক্তার সফলতা আসবে।
মৌ দাস: উদ্যোক্তা হিসেবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা কেমন?
মাহাবুব মোর্শেদ: অনেকেই বলে তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করো। এই ছোট দোকান নিয়ে কী জন্য পড়ে আছো। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়ে দোকান করা মানায় না। এই কথাটা অনেকেই বলে থাকে।
সবাই ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়ে দোকান করে এই গতানুগতিক ধারার থেকে বের হওয়ার মানুষের প্রবণতা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে যে ব্যবসা করা যাবে, তরুণেরা সমাজে দৃষ্টান্ত হবে এমনটা কারো ভাবনায় নেই। সবাই ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে চাকরি করে, এমন প্রবণতা সবার মধ্যে বিরাজ করে। একজন তরুণের এমন উদ্যোগ দিয়ে যে অনেক কিছু করা সম্ভব, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজের চিত্র পাল্টে দেয়া যায় সেটা তারা ভাবে না। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে আসলে এই কাজটা ভালভাবে নেয় না। তবে আমাকে বন্ধুরা অনেক সাপোর্ট করেছে। আমার বন্ধু ইমরান সবসময় আমার পাশে ছিল।
মৌ দাস: আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পড়ালেখা পাশাপাশি টিউশন বা পার্ট টাইম চাকরি খুঁজতে ব্যস্ত থাকে, সেক্ষেত্রে আপনি ভিন্ন হলেন কেন?
মাহাবুব মোর্শেদ: আমি চিন্তা করলাম যদি টিউশন করি তাহলে তো সারাজীবন টিউশন করাতে পারব না। আমি যদি একটা ব্যবসা চালু করতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে অনেক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারব। প্রান্তিক মানুষের মধ্যে একটা সেবা পৌঁছে দিতে পারব সেইসাথে কিছু মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের জায়গা তৈরি করতে পারব।
আরেকটা বিষয় ছিল কম টাকায় কীভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে খাবার বিক্রি করা যায়। যেহেতু বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত সমাজের, তাদের মধ্যে অল্প টাকায় একটু ভালো খাবার পরিবেশনের জন্য একটা উদ্যোগ নিলাম। পড়াশোনার পাশাপাশি যে বেকারত্ব কমিয়ে আনা যায় সেই ভাবনা থেকে এই উদ্যোগ গ্রহণ করা। বেকারত্ব থেকে মুক্তির উপায় বের করা যেন এটা দেখে আরও শিক্ষার্থী অনুপ্রেরণা পায় তারাও যেন কোনকিছুকে অবজ্ঞা করে সমাজকে বেকারত্বমুক্ত করতে পারে এবং নিজের খরচ নিজে চালিয়ে পড়াশোনা করতে পারে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে অনেক সময় চাকরির পিছনে ছুটে চলে যায় এটা না করে যেন নিজে কিছু করার আত্মবিশ্বাস পায় যে স্বাধীন একটা কাজ করে অনেক কিছু করা সম্ভব।
মৌ দাস: শুরুর সময় ও বর্তমান কতটা পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে?
মাহাবুব মোর্শেদ: শুরুতে পুঁজি ছিল দুই লাখের একটু বেশি এখন ইনশাআল্লাহ এটা বেড়ে তিন লাখের একটু বেশি হয়েছে।
মৌ দাস: আপনার এমন উদ্যোগে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা কার কাছ থেকে পেয়েছেন?
মাহাবুব মোর্শেদ: প্রতক্ষ্যভাবে সহযোগিতা বলতে নাজমুল ভাই, বন্ধু সাহান মাসুদ, ইমরান এরা আমাকে সরাসরি সাপোর্ট করেছে। মানসিকভাবে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দিয়েছে ইমরান।
মৌ দাস: উদ্যোক্তা হওয়া আসলে শখ থেকে নাকি প্রয়োজনে হয়েছে?
মাহাবুব মোর্শেদ: আসলে শখ থেকে না বা প্রয়োজন থেকেও না। আমার ইচ্ছা হচ্ছে যেন শিক্ষার্থীরা কম টাকায় একটু ভালো খাবার খেতে পারে। এর পাশাপাশি কয়েকজন শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারি। অনেক শিক্ষার্থীর কাজের সুযোগ থাকে না, টিউশন পায় না। তাদের যেন কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। যদি পড়ালেখার পাশাপাশি পার্টটাইম জবের ব্যবস্থা করতে পারি তাহলে একটু সাপোর্ট হবে তাদের।
মৌ দাস: আপনার খাবার ক্রেতাদের কতটা আকৃষ্ট করে?
মাহাবুব মোর্শেদ: সবমিলিয়ে আলহামদুলিল্লাহ খাবারের রিভিউ সবসময় পজিটিভ থাকে। রংপুরের যে খাবারের একটা গ্রুপ আছে সেখানে বারবার পজিটিভ রিভিউ আসে। আমার এখানে ক্রেতাদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি, তবে বাইরেরও অনেক ক্রেতা আসে।
মৌ দাস: রেস্টুরেন্ট চালাতে কোন প্রতিকূলতার মধ্যে পড়েছেন?
মাহাবুব মোর্শেদ: এখনো প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়নি। এখানে ব্যবসা করার যথেষ্ট উপযুক্ত একটা জায়গা আছে। এখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতারা সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাদের একটা সুনজর আছে সময়। আলহামদুলিল্লাহ এখন পর্যন্ত কোন ঝামেলা হয়নি।
মৌ দাস: আপনার রেস্টুরেন্টের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী এবং ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোন নতুন পদক্ষেপ বা উদ্যোগ আছে কি না?
মাহাবুব মোর্শেদ: আমার রেস্টুরেন্টের নাম ভার্সিটি ক্যাফে। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা বেরোবির বুকে একটা ব্র্যান্ড হিসেবে থেকে যাবে। আমার ইচ্ছা আমি এখানে না থাকলেও যেন শিক্ষার্থীরা অল্প মূল্যে ভালো খাবার খেতে পারে, আর এই রেস্টুরেন্ট সবসময় ভালো খাবার সার্ভ করতে পারে এটা হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য। এটাকে আমি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাই। বেরোবির শিক্ষার্থীরা যাতে আমার পাশে থাকে এটাই আমার চাওয়া।
মৌ দাস: উদ্যোক্তা হওয়ার পূর্ব শর্তগুলো কী কী?
মাহাবুব মোর্শেদ: উদ্যোক্তা হতে হলে সঠিক কারণ জানা ও বোঝার প্রয়োজন আছে। আমি কেন উদ্যোক্তা হচ্ছি বা হতে চাচ্ছি সেটা আগে নিজেকে ঠিক করতে হবে। কিছু কারণ আছে এমন যে ‘চাকরি পাচ্ছি না-তাই উদ্যোক্তা হবো’, ‘চাকরিতে হতাশা- তাই উদ্যোক্তা হতে হবে’ বা ‘চাকরি এমন পর্যায়ে আছে যে এখানে আর অর্জন করার মত কিছু নেই তাই উদ্যোক্তা হতে হবে।’ শুধু এসব কারণে উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য ইচ্ছাশক্তির পাশাপাশি নিজের ভেতর থেকে কিছু একটা অর্জন করার জোরালো তাগিদ থাকতে হয়। নিজের সময় ভালো যাচ্ছে না বলে কিছু একটা করলাম আর ভালো কোনও সুযোগ এলে তখন আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেলাম, এরকম হলে সংগ্রাম করার সহনশীলতা থাকে না।
উদ্যোক্তা হতে গেলে সংগ্রাম করতে হয়। অনেক ত্যাগের প্রয়োজন হয়। উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা করার জন্য সঠিক মানসিকতা হচ্ছে, হাল না ছেড়ে সংগ্রাম করে এগিয়ে যাওয়া এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তি ধরে রাখা
মৌ দাস: অন্য কেউ নতুন উদ্যোক্তা হতে চাইলে তাদের উদ্দেশ্য পরামর্শ কী?
মাহাবুব মোর্শেদ: অন্য কেউ নতুন উদ্যোক্তা হতে চাইলে প্রথমে আমি বলব, কেউ যেনো ইউটিউব দেখে ব্যবসায় না নামে। আসল কথা হচ্ছে ধৈর্য আর পরিশ্রম যদি সঠিকভাবে দিতে পারে তাহলে সফলতা আসবে। নতুন উদ্যোক্তার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে।