কক্সবাজারের উখিয়ার চার নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনুমোদন ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছে কানাডাভিত্তিক এনজিও হিউম্যান কনসার্ন ইন্টারন্যাশনাল-এইচসিআই। বাংলাদেশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রান্তিক উন্নয়ন সোসাইটির সাথে যৌথভাবে ২০১৮ সাল থেকে চলছে তাদের কার্যক্রম।
জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগ ও আয়কর আইন লঙ্ঘনের কারণে ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে এইচসিআইকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে কানাডা রেভিনিউ এজেন্সি (সিআরএ)। সংস্থাটিকে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় চার কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৫ ও ২০১৯ সালে এইচসিআই’র পাকিস্তান শাখার সে সময়ের প্রধান আহমেদ কাদির ও আলী নেওয়াজকে জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ছিলেন আল-কায়েদার সদস্য আহমেদ কাদির। তিনি পাকিস্তানে এইচসিআই’র অর্থায়নে একটি এতিমখানা চালাতেন। ওই সময় সে এতিমখানার সহায়তাপ্রাপ্ত অনেকেই আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেয়।
এছাড়াও উইকিপিডিয়ার তথ্য বলছে, আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন ১৯৯৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘১৩টি দেশ থেকে তার দলের প্রতিষ্ঠার জন্য অনুদান আসতো, যা সংগ্রহ করতো হিউম্যান কনসার্ন ইন্টারন্যাশনাল।’
এনজিও ব্যুরোর তথ্য বলছে, মূল দাতা সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওব্যাট হেলপারসের নামে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের জন্য সাতটি প্রকল্প গত ৩০ জুন শেষ করে প্রান্তিক। তবে এইচসিআই’র নামে প্রকল্প চালানোর অনুমোদন নেই তাদের। এরপরও পার্টনার দেখিয়ে এইচসিআই’র অর্থায়নে চাইল্ড সাপোর্ট প্রোগ্রাম (সিএসপি) প্রকল্প চালাচ্ছে প্রান্তিক।
গত ২৫ জুন এই প্রকল্পের আওতায় ৩৫৩ জন রোহিঙ্গা শিশু এবং উখিয়ার ৫০ জন এতিম শিশুকে সহায়তা দেওয়া হয়। অনলাইন ডাটাবেজের মাধ্যমে এসব শিশুর তথ্য এইচসিআইকে পাঠায় প্রান্তিক। এছাড়া প্রতি মাসে প্রান্তিকের ব্যবস্থাপনায় ভিডিও কনফারেন্সে দাতাদের সাথে কথা বলে শিশুরা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঠ পর্যায়ে প্রান্তিকের শিক্ষা প্রকল্পভুক্ত এসব কার্যক্রম পরিচালনা করেন হাসান নামে এক রোহিঙ্গা নাগরিক। তাকে প্রতি মাসে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য নির্ধারিত বেতনের থেকেও তিনগুণ বেশি অর্থ দেওয়া হয়। এছাড়াও সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ২৫ শতাংশ কর্মী নিয়োগ করার কথা থাকলেও প্রান্তিকে রোহিঙ্গা কর্মীর সংখ্যার তুলনায় স্থানীয় কর্মীর সংখ্যা খুবই নগণ্য।
চলতি বছরের মার্চ মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে বাংলাদেশে আসে এইচসিআই’র একটি প্রতিনিধি দল। পরে প্রান্তিকের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের প্রকল্প পরিদর্শনের জন্য শরণার্থী ত্রাণ ও কমিশনার কার্যালয়ে অনুমতি নেয়।
সাত ও নয় মার্চ এইচসিআই’র বর্তমান প্রধান ড. ইরফান শেখের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলটি চার নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের কার্যক্রম পরিদর্শনসহ সুবিধাভোগী রোহিঙ্গা শিশু ও তাদের পরিবারের সাথে মতবিনিময় করে। মূলত প্রান্তিকের মাধ্যমে অনুমোদন নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিজেদের কার্যক্রমকে বৈধ করার লক্ষ্যেই ছিল এইচসিআই সংশ্লিষ্টদের এই সফর।
অতীত বিতর্কের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নির্দিষ্ট সংখ্যক উপকারভোগী এবং শুধু তাদেরই নিয়মিত সহায়তা দেওয়ার পেছনে জঙ্গিবাদ পৃষ্ঠপোষকতার উদ্দেশ্য আছে কি না জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এইচসিআই ও তাদের সহযোগী প্রান্তিকের বিরুদ্ধে এমন প্রশ্নও উঠেছে। বিতর্কিত এই সংস্থা দুটির কার্যক্রম দ্রুত বন্ধের কথাও বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলছেন, ‘সত্যিকার অর্থেই যদি দাতব্য সংস্থা বা এনজিওর কার্যক্রম বিতর্কিত হয়, তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগ থাকে তাহলে ক্যাম্প থেকে দ্রুত বের করে দেওয়া উচিত। কারণ, এ ধরনের সংস্থা দেশের জন্য একদিন হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।’
প্রান্তিকের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ কুমার বিশ্বাস অটল জানান, ‘আমরা ওব্যাট হেলপারসের অর্থায়নে কাজ করছি। তাই ওব্যাট হেলপারসের নির্দেশে এইচসিআইয়ের ব্যানারটা ব্যবহার করছি আমরা। এছাড়া বাকি অভিযোগগুলো মিথ্যা, যার কোনও ভিত্তি নেই। তবে আমরা খুব দ্রুত সময়ে বিষয়টি সবার সামনে পরিষ্কার করবো।’
এদিকে, যাচাই না করেই সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা সম্মানীর নামে মোটা অঙ্কের অর্থসহ নানা ধরনের অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিতর্কিত এই এনজিওর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে থাকেন। এতেও প্রশ্ন উঠেছে এনজিওটির কার্যক্রমকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে কি না।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) নাসিম আহমেদ বলেন, ‘ওই এনজিও কার্যক্রমের বিষয়টি আমরা জেনেছি। তদন্তপূর্বক পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’