পটুয়াখালীর বাউফলে টাকা বিনিময় গোপনে উপজেলা ও ১৫টি ইউনিয়ন বিএনপির কমিটি গঠন, ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন, স্বজনপ্রীতি, নিস্ত্রিয়, দলীয় কর্মকাণ্ডে জড়িত নয় ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের পদ দেওয়াসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে উপজেলা বিএনপির দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগও আমলে নিয়েছেন দলের মহাসচিব। বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমানকে দেওয়া হয়েছে তদন্তের দায়িত্ব। আগামী ২৮ নভেম্বর জেলা বিএনপি কার্যালয়ে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হবে। এছাড়াও স্থগিত করা হয় উপজেলা বিএনপির ২৬ নভেম্বরের সম্মেলন।
এদিকে, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দল বিএনপি যখন সরকার বিরোধী আন্দোলনে ব্যস্ত তখন বাউফল বিএনপির এমন বির্তকিত কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তৃণমূল বিএনপির নেতৃবৃন্দ।
উপজেলা বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, গত বছরের ২৫ নভেম্বর উপজেলায় মো. শাহজাদা মিয়াকে আহ্বায়ক ও মো. অলিয়ার রহমানকে সদস্য সচিব ও হুমায়ন কবিরকে আহ্বায়ক ও এটিএম মিজানুর রহমানকে সদস্য সচিব করে পৌর বিএনপির কমিটি ঘোষণা করে জেলা বিএনপি। সাবেক এমপি শহিদুল আলমকে করা হয় পৌর বিএনপির সদস্য ও তার সহধর্মীণী সালমা আলম লিলিকে উপজেলা বিএনপির সদস্য করা হয়। এনিয়েও সমালোচনা হয়।
এই উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব বিভিন্ন ইউনিয়নের কমিটি গঠন নিয়ে বাণিজ্যে মেতে উঠেন। টাকার বিনিময়ে কমিটি দেওয়া নিয়ে আহ্বায়ক শাহজাদা মিয়া, সদস্য সচিব অলিয়ার রহমান ও যুগ্ম-আহ্বায়ক আপেল মাহমুদ ফিরোজের কথোপকথনের অডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এনিয়ে শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা। আহ্বায়ক শাহজাদা মিয়া ও সদস্য সচিব অলিয়ার রহমানকে অব্যাহতি দিয়ে আব্দুল জব্বারকে আহ্বায়ক ও আপেল মাহমুদ ফিরোজকে সদস্য সচিব করা হয়। যা নিয়ে চলছে নতুন সমালোচনা।
অভিযোগ উঠেছে, আহ্বায়ক জব্বার ২০১৬ সালে বাকেরগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপাশা ইউপি নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ করেছেন। অপরদিকে সদস্য সচিব আপেল মাহমুদ ফিরোজেরও কমিটি বাণিজ্যের সাথে জড়িত। যার কথোপকথনের অডিও ফাঁস হয়েছিল।
এই দুই নেতাও একই পথে হাঁটেন, শুরু করেন কমিটি বাণিজ্য। ঘোষণা করা হয় একের পর এক ইউনিয়ন বিএনপির কমিটি। এসব ইউনিয়ন কমিটি গঠন নিয়ে আবারও পদ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, ত্যাগের অবমূল্যায়ন, নিস্ক্রয়দের পদ দেওয়াসহ ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠে।
ঢাকায় বসে ত্যাগীদের পদ না দিয়ে টাকার বিনিময় গোপনে কমিটি ঘোষণার প্রতিবাদ জানিয়ে বিএনপির মহাসচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. তসলিম তালুকদার ও মো. আনিচুর রহমান।
এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে ২৬ নভেম্বর উপজেলা বিএনপির সম্মেলন বন্ধ ঘোষণা ও ইউনিয়ন কমিটির বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বরিশাল বিভাগীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
উপজেলা বিএনপির একাধিক যুগ্ম আহ্বায়ক ও বিভিন্ন ইউনিয়ন বিএনপির নেতারা জানান, আহ্বায়ক আব্দুল জব্বার ও সদস্য সচিব আপেল মাহমুদ ফিরোজ ঢাকায় বসে টাকার বিনিময় গোপনে বিভিন্ন ইউনিয়ন কমিটি ঘোষণা করেন। যাতে ত্যাগীদের বাদ দিয়ে নিষ্ক্রিয় ও অরাজনৈকিত ব্যক্তিদের পদ দেওয়া হয়। তারা দলীয় কর্মকাণ্ডে জড়িত না, ঢাকায় ব্যবসা বাণিজ্য করেন।
তারা আরও অভিযোগ করেন, গত ২১ নভেম্বর উপজেলা কালাইয়া ইউনিয়ন বিএনপির কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিতে ঢাকায় বসবাসরত মো, জসিম উদ্দিন তুহিনকে সভাপতি ও ন্যাপের রাজনীতির সাথে জড়িত আতাহার উদ্দিন সিকদারকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজাহান মাতুব্বর ও সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. নুর হোসেন খাঁনকে করা হয় সদস্য। বাউফল ইউনিয়ন বিএনপির কমিটিতে ঢাকায় বসবাসরত মো. ফারুক গাজীকে সভাপতি করা হয়েছে। দাশপাড়া ইউনিয়নে সাবেক সভাপতি আব্দুল খালেককে বাদ দিয়ে আওয়ামীলীগের ইউপি চেয়ারম্যানের আত্মীয় ও ঢাকায় বসবাসরত মো. আলী আজমকে সভাপতি ও দলীয় কর্মকান্ডে নিষ্ক্রিয় মো. মজিবুর নামের এক ব্যক্তিকে করা হয় সাধারন সম্পাদক। একই অবস্থা চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নে। সাবেক সভাপতি ও ত্যাগী নেতা সামসুল হক হাওলাদারকে বাদ দিয়ে বেল্লাল ব্যাপারীকে সভাপতি করা হয়। যিনি দলীয় কর্মকান্ডে নিষ্ক্রিয়। এছাড়াও বাউফলে বিএনপির দূর্গখ্যাত ইউনিয়ন ধুয়িলা বিএনপিতে স্বজনপ্রীতি করে উপজেলা আহ্বায়কের ভাই মো. নজরুল ইসলামকে সভাপতি করা হয়েছে। নজরুল ইসলাম ব্যবসার কাজে ঢাকায় থাকেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথেও নজরুল ইসলামের যোগাযোগ রয়েছে।
এছাড়াও সূর্যমণি বিএনপির সভাপতি মো. মনির ও নাজিরপুর বিএনপির সভাপতি মো. হেলাল মুন্সি ঢাকায় থাকেন। এমন অভিযোগ কেশবপুর, নওমালা, কালিশুরী ইউনিয়ন বিএনপির কমিটি নিয়েও।
উপজেলা বিএনপির একাধিক যুগ্ম আহ্বায়ক জানান, বাউফল বিএনপির জনপ্রিয় নেতা ও সাবেক এমপি শহিদুল আলম তালুকদারকে কোণঠাসা করার জন্য কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক মুহাম্মাদ মুনির হোসেন মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। জড়িয়ে পড়েছেন দলীয় কোন্দলে। পৃথকভাবে করেন দলীয় প্রোগ্রাম। উপজেলা বিএনপির এই বিভেদ ও বিশৃঙ্খলার জন্য ওই নেতাই দায়ী।
কালাইয়া বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদবঞ্চিত মো. শাহজাহান মাতুব্বর বলেন, ‘আমি দুইবার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। দলের জন্য অসংখ্য বার নির্যাতিত হয়েছি। আমাকে করা হয়েছে ৪৮ নং সদস্য।
উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক তসলিম তালুকদার বলেন, ‘দুর্দিনে দলের জন্য কাজ করেছেন এমন ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে টাকার বিনিময় স্বজনপ্রীতি করে অদক্ষ অসাংগঠিনক এবং এলাকায় থাকেন না এমন ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে কেন্দ্রেীয় বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক মোহাম্মাদ মুনির হোসেনের নির্দেশে ঢাকায় বসে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল জব্বারের মুঠোফোনে একাধিক বার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। বন্ধ পাওয়া যায় সদস্য সচিব আপেল মাহমুদের মুঠোফোন।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক স্নেহাংগু সরকার কুট্টি বলেন, ‘দলের মহাসচিব এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে বরিশাল বিভাগের সহ-সাংগঠনিক আকন কুদ্দুসুর রহমানকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন। তদন্ত সাপেক্ষ দল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।