বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রথম নকশাকার জাসদ নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধায় শেষ বিদায় জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হয়। সেখানে প্রথমে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। এরপর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে বেলা ১২টা পর্যন্ত বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতি অঙ্গনের ব্যক্তিরা তাকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
শহীদ মিনারে শিব নারায়ণ দাসের কফিনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, সুজিত রায় নন্দী, সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। তাদের সঙ্গে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খানও শ্রদ্ধা জানান।
শ্রদ্ধা নিবেদনের পর আব্দুর রাজ্জাক বলেন, শিব নারায়ণ দাসের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন, যে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগ এদেশের সকল আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। সর্বোপরি তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার একজন লড়াকু কর্মী ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের জাতীয় পতাকার নকশা করার ব্যাপারে তিনি অবদান রেখেছেন। এটা ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে। আমরা পুরো জাতি তার প্রতি শ্রদ্ধাবনত।
শহীদ মিনারে শিব নারায়ণ দাসকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ ও উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছার।
অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, একটা রাষ্ট্র বর্তমান থাকতে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে সংগ্রাম চলছিল, সেই সংগ্রামের অংশ হিসেবে আরেকটি রাষ্ট্রের পতাকা তৈরি করা ছিল অত্যন্ত দুঃসাহসী কাজ। সেই দুঃসাহসী কাজটি করেছে ছাত্রলীগের নেতারা, সেটার নকশা তৈরি করেছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আমাদের শিবু দা। আমরা তার প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই।
শ্রদ্ধা জানাতে এসে জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, শিব নারায়ণ ছিলেন আপাদমস্তক একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাকে আমরা শুধু জাতীয় পতাকা অংকনের জন্যই মনে রাখব না, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি জাসদের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি দেশের জন্য অকাতরে সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। শেষ সময়ে এসেও তিনি তার দেহ ও চক্ষু দেশের জন্য দান করে গেছেন।
শিব নারায়ণ দাসের ছেলে অর্ণব আদিত্য দাস বলেন, আমার বাবা এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি কখনো অন্যায়, দুর্নীতি ও মিথ্যাচারের সাথে আপস করেননি। বাংলাদেশের অস্তিত্ব, মুক্তিযুদ্ধে চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে তিনি কখনো আপস করেননি। আমার বাবার আদর্শকে অনুসরণ করে আপনারা এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, এটা আমার প্রত্যাশা।
তিনি বলেন, আমার বাবা সব সময় একটি কথাই বলে গেছেন, এই দেশের নিপীড়িত ও নির্যাতিত যে সকল মানুষ রয়েছে, তাদের জন্য কথা বলতে হবে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাসদ, বাসদ, ওয়ার্কাস পার্টি, জেএসডি, জাতীয় যুব জোট, কেন্দ্রীয় খেলাঘর, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, গণজাগরণ মঞ্চ, সহযাত্রী, জাসদ ছাত্রলীগ, পাঁচদলীয় বাম জোট, বাংলাদেশ গণ সংগীত সমন্বয় পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শিব নারায়ণ দাসকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানোনো হয়।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শিব নারায়ণ দাশের মরদেহ তাঁর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিকেলে মরদেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তান্তর করা হবে। শুক্রবার সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের আইসিইউতে মারা যান ৭৮ বছর বয়সী শিব নারায়ণ দাস। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শিব নারায়ণ দাসের চোখ সন্ধানীতে দান করা হয়েছে এবং তার দেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করা হবে।
১৯৭০ সালের সাত জুন ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশ গ্রহণের কথা ছিল। এই জন্য ছাত্রদের নিয়ে একটি জয়বাংলা বাহিনী, মতান্তরে ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’ গঠন করা হয়। ছাত্র নেতারা এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৭০ সালের ছয় জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১০৮ নং কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন।
এ বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ন দাস, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন।
সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে সবার আলোচনার শেষে সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কামরুল আলম খান (খসরু) তখন ঢাকা নিউ মার্কেটের এক বিহারি দর্জির দোকান থেকে বড় এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনলেন; এরপর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়েদে আজম হল (বর্তমানে তিতুমীর হল)-এর ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হলো পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। শিবনারায়ণ দাস পরিশেষে তার নিপুণ হাতে মানচিত্রটি আঁকলেন লাল বৃত্তের মাঝে, এমনি করে রচিত হলো ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’র পতাকা, যা কিছুদিন পর স্বীকৃত হয় বাংলাদেশের প্রথম পতাকা হিসেবে।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার পরিবর্তে শিবনারায়ন দাশের নকশা করা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার শিবনারায়ন দাসের নকশা করা পতাকার মধ্যে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ, ও তার ব্যাখ্যা সংবলিত একটি প্রতিবেদন দিতে বলে পটুয়া কামরুল হাসানকে। কামরুল হাসান দ্বারা পরিমার্জিত রূপটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
১৯৭০ সালের ছয় জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১১৬ নং কক্ষে রাত ১১টার পর পুরো পতাকার নকশা সম্পন্ন করেন। এ পতাকাই পরবর্তীতে ১৯৭১-এর দুই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় উত্তোলন করা হয়।
শিবনারায়ণ দাসের বাবা সতীশচন্দ্র দাস কুমিল্লাতে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা করতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি হানাদাররা তাকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। শিবনারায়ণ দাসের স্ত্রীর নাম গীতশ্রী চৌধুরী এবং সন্তান অর্ণব আদিত্য দাস।