জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতি তহবিল চালু: নগণ্য বলছেন বিশেষজ্ঞরা

গেল বৃহস্পতিবার থেকে দুবাইয়ে শুরু হয়েছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮। এবারের সম্মেলন চলবে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত৷ জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এক হয়েছেন কীভাবে এই জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে বিশ্বকে রক্ষা করা যায়। আর সে লক্ষ্যে নানা ইস্যুতে মিলিত হয়েছেন বিশ্বনেতৃবৃন্দ।

দুবাই কপের প্রথম দিনই ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ (ক্ষয়ক্ষতি) তহবিলের বিষয়ে ঐকমত্য এ বছরের বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলনকে দুর্দান্ত শুরু এনে দিয়েছে। সম্মেলনের প্রথম দিনে লস এন্ড ড্যামেজের আওতায় ৪২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘোষণা করে বিশ্বের ৫ রাষ্ট্র। এই তহবিলের জন্য দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে লড়াই করে আসছিল জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা ছোট দ্বীপদেশগুলো।

এদিকে জলবায়ু সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বাংলাদেশের জন্য একটি অর্জন দিয়ে শুরু হয়েছে। এদিন জলবায়ু সম্মেলনের আসর থেকে এশিয়ার ক্লাইমেট মোবিলিটি চ্যাম্পিয়ান লিডার অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জলবায়ু বিষয়ে কর্মকাণ্ডে নেতৃত্বের কণ্ঠস্বর হিসেবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিযুক্ত মানুষের পক্ষে বিশ্বব্যাপী অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ক্লাইমেট মোবিলিটি চ্যাম্পিয়ন লিডার অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত করে আইওএম এবং জাতিসংঘ সমর্থিত গ্লোবাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট মোবিলিটি সংস্থা।

এদিকে, কপ-২৮ সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জলবায়ু প্রকল্পের জন্য একটি নতুন তিন হাজার কোটি ডলারের বেসরকারি বিনিয়োগ তহবিল চালুর ঘোষণা দিয়েছে।

সম্মেলনে তেলসমৃদ্ধ আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান সম্মেলনে এই নতুন তহবিলের কথা ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, তাঁরা আশা করছেন ‘আলটেরা’ নামের নতুন তহবিলটি ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ২৫ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগকে অনুপ্রাণিত করবে।

এছাড়া এ সংক্রান্ত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কপ-২৮-এর সভাপতি আমিরাতের জাতীয় তেল কম্পানি অ্যাডনকের প্রধান সুলতান আল জাবের নতুন এই তহবিলের বোর্ডের সভাপতি হবেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তহবিলটি একটি ন্যায্য জলবায়ুু অর্থায়নের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নেবে এবং এতে বৈশ্বিক দক্ষিণের (অনগ্রসর বিশ্ব) জন্য তহবিল পাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হবে।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মতে, চীন বাদে উদীয়মান বাজার এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোকে তাদের জলবায়ু ও উন্নয়নের চাহিদা মোকাবেলায় প্রতিবছর দুই লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে, যা বিনিয়োগের বর্তমান স্তরের অনেক ওপরে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদ্যোগটিকে কপ২৮-এর জন্য দেশটির বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। স্বেচ্ছায় নিজেরা বড় অঙ্কের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পাশাপাশি এর মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতে ২০২৫ সালের মধ্যে বায়ু ও সৌর প্রকল্প নির্মাণসহ ছয় গিগাওয়াটের বেশি পরিবেশ অনুকূল জ্বালানি উৎপাদনের জন্য এরই মধ্যে অর্থ আলাদা করা হয়েছে। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জন্য আরও প্রকল্প খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত নিজেকে কার্বন নিঃসরণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ধনী উন্নত দেশ এবং বাকি বিশ্বের মধ্যে একটি সেতু হিসেবে দেখে।

সামিটে যোগ দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ও ব্রিটেনের রাজা চার্লসসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। এবারের কপ লিডার্স সামিটে যোগ দেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আর শারীরিক অসুস্থতার কারণে যোগ দিতে পারেননি খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস। তবে এক বার্তায় পোপ ফ্রান্সিস বলেন, কপ-২৮ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা নির্দিষ্ট কিছু দেশ বা ব্যবসার স্বার্থের পরিবর্তে সকলের ভালো এবং নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যতের দিকে মনোনিবেশ করবেন।

এদিকে সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন লস অ্যান্ড ড্যামেজের আওতায় নতুন করে ইতালি ১০৮ দশমিক ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ডেনমার্ক ২৫ মিলিয়ন, নেদারল্যান্ড ১৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন, যুক্তরাজ্য ৫০ দশমিক ৬ মিলিয়ন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২৭ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া এডাপটেশন ফান্ড হিসেবে সুইজারল্যান্ড ১৭ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারসহ সব মিলিয়ে প্রথম দুই দিনে প্রায় ৫৭৫ দশমিক ৮ মিলিয়ন ইউএস ডলারের ঘোষণা এসেছে জলবায়ু সম্মেলন থেকে। এরমধ্যে সম্মেলনের প্রথম দিনই লস অ্যান্ড ড্যামেজের আওতায় এসেছিল প্রায় ৪২৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘোষণা দেয় বিশ্বের ছয় রাষ্ট্র। এছাড়া শুক্রবার পর্যন্ত গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড হিসেবে ৯ দশমিক এক বিলিয়ন ডলার ফান্ড গঠন হয়েছে। তবে এই অর্থ থেকে বাংলাদেশ তাদের প্রাপ্য কতটুকু আদায় করে নিতে পারবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। তারা জানান, প্রক্যেকটি দেশ অর্থ দিবে বিশ্ব ব্যাংকের মাধ্যমে।

এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে যে অর্থ দেওয়া হবে সেটি থেকে বিশ্বব্যাংক তার পরিচালনা ব্যয় হিসেবে একটি বড় অংশ নিয়ে যাবে। এতে করে এই ফান্ডের যে মুখ্য উদ্দেশ্য সেটি অর্জিত হওয়ার পথে একটি বাধা হয়ে দাঁড়াবে। বিশ্বব্যাংকের লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডটি অনুদান না হয়ে যদি ঋণ হয়ে যায় তাহলে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের জন্য নতুন ঋণের বোঝা হিসেবে দেখা দিতে পারে।

সম্মেলনে যোগ দেওয়া বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের সদস্য পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মো. কাউসার আহাম্মদ বলেন, ক্ষয়ক্ষতির তহবিল হিসেবে এই দুদিনে যতটুকু প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে তা মোট প্রয়োজনের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র অংশ। তাই এই মুহূর্তে উত্তরের উন্নত দেশগুলোকে দক্ষিণের উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে প্রাণ, জীবিকা, জীববৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইত্যাদি সব কিছুকে বিপন্ন করে তোলার দায় মেটাতে শেষ পর্যন্ত শিল্পোন্নত দেশগুলো রাজি হলেও তহবিলে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্থের প্রতিশ্রুতি মিলেছে, তা নগণ্য।

গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুধু ২০২২ সালেই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি ডলার। আর তহবিলে এখন পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি মিলেছে মাত্র ৪৭ কোটি ৫০ লাখ ডলারের মতো। এই তহবিলে শুরুতেই বছরে অন্তত ৪০ হাজার কোটি ডলার দরকার। ১০ হাজার কোটি ডলার বা তার নিচে থাকলে এই ক্ষতিপূরণ লোক-দেখানোই হবে, কোনো কাজে আসবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।