বগুড়ার সদরে করতোয়া নদী ভরাট করে সড়ক নির্মাণের দায়ে বেসরকারি সংস্থা ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘকে (টিএমএসএস) ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সোমবার দুপুরে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফিরোজা পারভীনের ভ্রাম্যমাণ আদালতে এই দণ্ড দেয়া হয়।
এর আগে গত শনিবার টিএমএসএস নদী ভরাট করছে এমন অভিযোগে অভিযান চালায় উপজেলা প্রশাসন। ওই সময় নদীর সীমানা দখল করলে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী জরিমানা দিতে রাজি থাকার মর্মে মুচলেকা দেন টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা। মুচলেকা অনুযায়ী নদী এলাকায় টিএমএসএসের যাবতীয় কাজ বন্ধ রাখার কথা ছিল।
ওই দিনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সোমবার নদীর সীমানা পরিমাপ করেন ইউএনও ফিরোজা পারভীন। এ সময় করতোয়া নদীর সীমানার মধ্যে ভরাট করে রাস্তা নির্মাণের সত্যতা পান তিনি। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন। অনাদায়ে টিএমএসএসের সিনিয়র সহকারী পরিচালক নজিবর রহমানকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
কিন্তু দণ্ডাদেশ দেয়ার পরপরই টিএমএসের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা গণ্ডগোল সৃষ্টি করেন। তারা আদালতের রায় পরিবর্তনের জন্য ইউএনও ফিরোজা পারভীনকে চাপ দিতে থাকেন।
এ সময় রায় অস্বীকার করে টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বলেন, এখানে একটি রাস্তা করা হয়েছে, এটি সাময়িক। এ রাস্তায় স্থানীয় লোকেরা চলাচল করে। এখানে পরিবেশের কোনও আইন লঙ্ঘন হয়নি। কারা অভিযোগ করেছে, কারা বলেছে এটা আপনার অফিসে বসে দেখা উচিত। আজকে আপনি নদী পরিমাপ করতে আসছেন। যথাযথভাবে পরিমাপ করে দেখেন কোথায় টিএমএসএস নদীর মধ্যে আসছে।’
আদালতের জরিমানার বিষয়টি নিশ্চিত করেন ইউএনও ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফিরোজা পারভীন। তিনি বলেন, শনিবার করতোয়া নদী ভরাটের অভিযোগে ঘটনাস্থলে এসেছিলাম। তখন আমি নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, তারা টিএমএসএসের জন্য কাজ করছেন। আমার কাছে তাদের বক্তব্য রেকর্ড করা আছে।
ইউএনও আরও বলেন, আজকে করতোয়া নদী পরিমাপের সীমানা নির্ধারণের দিন ছিল। পরিমাপে দেখা যায় করতোয়ার মাঝ দিয়ে বালু দিয়ে একটি রাস্তা নির্মাণ হচ্ছে। এছাড়াও আমি টিএমএসএসের অংশে ময়লা ও বালু ফেলা হচ্ছিল, সেই কাজ বন্ধ রাখতে বলেছিলাম। কিন্তু আজ এসে দেখি সেই কাজ চলমান ছিল। এ জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ সালের ১৫ ধারায় টিএমএসএসকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছি। অনাদায়ে একজনকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নদীর দখল-দূষণ দিয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও সার্বক্ষণিক সদস্য ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার ২০১৯ সালে বগুড়ার করতোয়া, যমুনা ও বাঙালি নদী সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তাদের দেওয়া প্রতিবেদনে করতোয়া দখলকারীদের বিরুদ্ধে বগুড়া জেলা প্রশাসককে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বগুড়া জেলা প্রশাসকের (পদাধিকার বলে জেলা নদী রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক) কাছে পাঠানো এই চিঠিতে উল্লেখ করে, নদীর জায়গায় অবৈধভাবে দখলে নিয়ে টিএমএসএস ভবন বা স্থাপনা তৈরি অব্যাহত রেখেছে। নদীর জায়গায় এভাবে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণে বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রিট পিটিশনের সংশ্লিষ্ট রায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবৈধ দখল থেকে নদীকে রক্ষা করতে সিআরপিসি আইনের ১৩৩ ধারা প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের জমি অবৈধভাবে দখলের দায়ে টিএমএসএসসহ অন্যান্য সব অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় ফৌজদারী মামলাও রুজু করতে হবে।
চিঠিতে আরও বলা হয় (পরামর্শ ২১) সদরের নওদাপাড়া মৌজায় মম ইন (ইকো পার্ক) পার্কের ময়লা-আবর্জনা করতোয়া নদীতে ড্যাম্পিং করা হচ্ছে এবং অবৈধভাবে নদী থেকে বালু তোলা হচ্ছে। এতে নদীর ভূগর্ভ ভেঙে তীর বসে যাচ্ছে। অবিলম্বে নদীতে ময়লা-আবর্জনা ড্যাম্পিং বন্ধ করতে হবে।
চিঠির আরেকটি অংশে উল্লেখ রয়েছে, মম-ইন এক্সটেনশন বিনোদন পার্ক করতোয়ায় বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম আইল্যান্ড তৈরি করেছে। নদীর গর্ভস্থলে এ ধরনের কৃত্রিম আইল্যান্ড তৈরি করে নদীকে দ্বিখন্ডিত করে নদীর দুপাশকে নদীর প্রবাহকে স্তিমিত ও গতিপথ পরিবর্তন করে করতোয়ার সর্বনাশ করছে। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি। জরুরি ভিত্তিতে এটি উচ্ছেদ করতে হবে।
টিএমএসএস রাষ্ট্রের বা নদীর জায়গা অবৈধ দখলে জড়িত থাকার ফলে জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থি কাজের জন্য ফৌজদারী আইনে মামলা রুজু করতে হবে।