একুশের ভাষা বীরদের প্রতি জাবি পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই দৃষ্টি আবদ্ধ হয়ে যায় দর্শনার্থীদের। সেখানে গুলিবিদ্ধ সন্তানের মৃতদেহ কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মা। তার পাশেই বজ্রমুষ্ঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন আন্দোলনরত বাবা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ঠিক অপর প্রান্তে কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার পাশে  দাঁড়িয়ে আছে অবিকল মানুষের প্রতিকৃতির একটি ভাষ্কর্য। নাম ‘অমর একুশ’। ভাষ্কর্যটির নকশা করেন শিল্পি জাহানারা পারভীন।

‘অমর একুশ’ মনে করিয়ে দেয় ত্যাগ আর অগণিত প্রাণের বিনিময়ে বাঙালির প্রাপ্তি। বিশ্বে বাঙালিরা একমাত্র জাতি যাদের ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে। ‘অমর একুশ’ নিয়ে যায় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে। যেদিন মাতৃভাষার জন্য ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করেছিল রাজপথে। পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, জব্বারদের তাজা প্রাণের লাল রক্তে বাঙালিরা নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষা করেছিল। ‘অমর একুশ’ মা-বাবার কোলে সন্তানের মৃতদেহকে দেখায়। মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে কংক্রিটের শরীরে জীবন্ত করে তুলে ধরা হয়েছে এই ভাষ্কর্যে।

১৯৯১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক কাজী সালেহ আহমেদ এই ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন। ভাস্কর্যটির মোট উচ্চতা ৩৪ ফুট। এটি নির্মাণ করা হয়েছে চুনাপাথর, সিমেন্ট, ব্ল্যাক কনক্রিট দিয়ে। এখান থেকে আর একটু সামনে গেলেই চোখে পড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশচুম্বী একটি ত্রয়ীস্তম্ভের মিনার। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু ‘শহীদ মিনার’। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে ভাষা সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় এই স্থানে।এই স্থাপত্যকর্মটির নকশা করেন স্থপতি রবিউল হুসাইন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ সালে তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. খন্দকার মুস্তাহিদূর রহমান এটি উদ্বোধন করেন।

১৯৫২ সালকে সকল অর্জনের ভিত্তি বিবেচনা করে এর ভিত্তিমঞ্চের ব্যাস রাখা হয় ৫২ ফুট এবং ৭১ সালের অবিস্মরণীয় মর্যাদার প্রতি সম্মান জানিয়ে ভিত্তিমঞ্চ থেকে উন্মুক্ত মিনারটির উচ্চতা রাখা হয় ৭১ ফুট। দেশ বিভাগোত্তর বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের স্বাধীনতা অভিমুখী নানা আন্দোলনে তাৎপর্যমন্ডিত আটটি বছর- ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭১ কে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ভিত্তিমঞ্চে ব্যবহার করা হয়েছে আটটি সিঁড়ি যা ধারাবাহিকতার প্রতীক। দৃঢ়তার প্রতীক ত্রিভুজাকৃতির ঋজু কাঠামোর মিনারের স্থাপত্বশৈলীতে বিদৃত হয়েছে সেইসব জাতীয় বীরদের বীরত্বগাথা যারা মায়ের ভাষা-ভূমির জন্যে লড়েছেন এবং প্রাণ বিসর্জন দিয়ে গেছেন।

প্রতিবছরের মত এবারও ২১ ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম প্রহরে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহিদ মিনারের পাদদেশে জাতীয় পতাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলন করে পূষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. নূরুল আলম।

শ্রদ্ধা নিবেদনকালে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. মনজুরুল হক, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক রাশেদা আখতার, প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসানসহ বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও বিভাগের সভাপতিরা এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

উপাচার্যের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বিশ্ববিদ্যালয় মহিলা ক্লাব, শিক্ষক সমিতি, অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, অফিসার সমিতি, বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, কর্মচারি সমিতি, কর্মচারি ইউনিয়ন, বিভিন্ন হল, বিভাগ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

leave a reply