সময়টা ২০১৫ সাল। অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে এ গ্রুপে ছয় ম্যাচের চারটিতেই হেরে বিদায় নেয় ইংল্যান্ড। তারা জিততে পারেনি কোনও টেস্ট খেলুড়ে দলের বিরুদ্ধে। বিশ্বকাপে এমন পরিণতির পর হতাশায় ছেয়ে যায় ইংল্যান্ড ক্রিকেট। ওয়ানডে ক্রিকেটে ইংলিশ ক্রিকেট টিমের সেকেলে এপ্রোচ নিয়ে সমালোচনায় মেতে দেশটির সাবেক ক্রিকেটার থেকে শুরু করে দুনিয়াব্যাপী ক্রিকেটবোদ্ধারা। বাদ যায়নি বার্মী-আর্মির মত সমর্থক গোষ্ঠীও।
২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পরই ইসিবির ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দায়িত্ব অর্পন করা হয় ইংলিশ ক্রিকেট টিমের সাবেক অধিনায়ক এন্ড্রু স্ট্রাউসের উপর। স্ট্রাউস দায়িত্ব নিয়েই স্বীকার করেন, ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে ওয়ানডে ক্রিকেটের তুলনায় টেস্ট ক্রিকেটকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় যা একদিনের ক্রিকেটে দলের সেকেলে এপ্রোচের মূল কারণ।
সমস্যার সমাধানে তিনি নির্বাচকদের আলাদা ওয়ানডে এবং টেস্ট দল গঠন করার নির্দেশ দেন। এবং তখনকার হেড কোচ পিটার মুরস’কে বরখাস্ত করে ট্রেভর বেলিসকে হেডকোচ হিসেবে দলের সাথে যুক্ত করেন। তখন ট্রেভর বেলিসকে সাদা বলের একজন বিশেষজ্ঞ কোচ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ২০১৯ বিশ্বকাপ পরিকল্পনাকে সামনে রেখে নতুন কোচের অধীনে ইংল্যান্ডের ওয়ানডে ক্রিকেট দলে খেলোয়াড় নির্বাচনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। যার ফলে বাদ পড়েন ফর্মে থাকা অনেক অভিজ্ঞ ক্রিকেটারও। এ ধরনের দল নির্বাচনের মূল লক্ষ্য ছিল ওয়ানডে ক্রিকেটে আরও বেশি আক্রমণাত্মক ভাবধারা নিয়ে আসা।
ইংলিশ ক্রিকেট দলের সে সময়ের এনালিস্ট নাথান ল্যামান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “হঠাৎই আমরা পরের সিরিজের লক্ষ্যে দল নির্বাচনের ধারণা থেকে সরে আসি এবং চার বছর পরের বিশ্বকাপের জন্য দল নির্বাচন শুরু করি।”
২০১৫ থেকে ২০১৯ আক্রমনাত্মক ক্রিকেটের মন্ত্রে এই চার বছরের মধ্যেই ইংল্যান্ড হয়ে উঠে ওয়ানডের ক্রিকেটের সেরা দল। ইয়্ন মরগানের নেতৃত্বে দলে সুযোগ পাওয়া একঝাঁক তরুণ টানা চার বছরের ক্রিকেটে অভিজ্ঞ ক্রিকেটারে পরিণত হয়। বেন স্টোকস, জনি বেয়ারস্টো, উডদের নিয়ে গড়া দলটি শিরোপার অন্যতম দাবিদার হিসেবেই ২০১৯ সালে স্বদেশে অনুষ্টিত বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে এবং রোমাঞ্চকর এক ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয়। ২০১৯ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের এই সাফল্য কোনও রুপকথা ছিলনা। এটি ছিল এন্ড্রু স্ট্রাউসের নেতৃত্বে ইসিবির চার বছর মেয়াদী পরিকল্পনার ফসল।
এরপরের গল্পটা আমাদেরই প্রতিবেশী দেশ ভারতের। রাহুল দ্রাবিড়ের নেতৃত্বে টেন্ডুলকার, গাঙ্গুলি, যুবরাজ সিং, কুম্বলে, হরভজন সিং, আগাকার, জহির খান, ইরফান পাঠান আর নতুন সেনসেশন মাহেন্দ্র সিং ধনিকে নিয়ে গড়া দুর্দান্ত একটি টিম নিয়ে ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলতে গিয়েছিল টিম ইন্ডিয়া। এক অর্থে তারার মেলা। এই দলের তিন জনের ওয়ানডেতে ব্যক্তিগত রান ১০ হাজারের উপরে। একজনের রানতো আবার ১৫ হাজার ছুঁই ছুঁই। কোচ গ্রেগ চ্যাপেল আর এক ঝাঁক বিদেশি কোচের বহর নিয়ে দলটি ছিল বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে বিভোর। ক্রিকেট বোদ্ধাদের নজরেও এই টিম ইন্ডিয়া ছিল বিশ্বকাপ ট্রফির অন্যতম দাবিদার।
কে জানতো এই দলটাই প্রথম ম্যাচে র্যাঙ্কিংয়ে নবম স্থানে থাকা দলের বিরুদ্ধে হোঁচট খাবে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে ৪ দলের গ্রুপ থেকে সুপার এইটে কোয়ালিফাই করাটাই ইন্ডিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়লো। এরপর বারমুডার বিরুদ্ধে বড় ব্যবধানে জিতলেও শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হলো মহাপরাক্রমশালী দলটিকে।
ক্রিকেটের পিছনে বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগের পরও এ ধরনের ফলাফল মেনে নিতে পারেনি ভারতের ক্রিকেটপ্রেমীরা। বিশ্বকাপে দলের এমন ভরাডুবির জেরে খেলোয়াড়দের বাড়িতে হামলা করে বসে বিক্ষুদ্ধ জনতা।
জনতার রোষানলে পুড়ে সম্বিত ফিরে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের। বিশ্বকাপের পরই ক্রিকেটকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয় বিসিসিসাই। ভবিষ্যৎ সাফল্যের পরিকল্পনায় সিনিয়র ক্রিকেটারদের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দিয়ে একঝাঁক তরুণ ক্রিকেটার নিয়ে গড়া হয় ওয়ানডে দল। ওয়ানডে ক্রিকেটের থেকে বিদায় নেন গাঙ্গুলি আগারকার এবং কুম্বলের মত লিজেন্ডরা। বিশাল রদবদল আনা হয় কোচিং প্যানেলেও। কোচ গ্রেগ চ্যাপেল থেকে শুরু করে কোচিং প্যানেলের প্রায় সব সদস্যকেই বিদায় জানানো হয় বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর। তখনকার বোর্ড সভাপতি শারদ পাওয়ার বিদায় নেন এর পরের বছর। তার বিদায়ে বোর্ড সভাপতির দায়িত্ব পান শশাঙ্ক মনোহর। হেড কোচ হিসেবে দলের সাথে যুক্ত হন সাউথ আফ্রিকান গ্যারি কারস্টেন। ঘরোয়া ক্রিকেটকে ঢেলে সাজানোর দায়িত্বও বর্তায় হেড কোচের উপর। তারই পরামর্শে ঘরোয়া ক্রিকেটকে শক্তিশালী করতে প্রথাগত ব্যাটিং সহায়ক পিচের ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে স্পোর্টিং উইকেট বানানোর উদ্যোগ নেয় বোর্ড।
মূলত এরপর থেকে বদলে যেতে থাকে ওয়ানডে ক্রিকেটে টিম ইন্ডিয়ার এপ্রোচ। ভারতের স্পিন এবং ব্যাটিং লাইনআপ ঐতিহ্যগতভাবেই দুর্দান্ত। সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা আসে পেস বোলিং ডিপার্টমেন্টে। উঠে আসে একঝাঁক মানসম্মত ফাস্ট বোলার। এরপরের গল্পটা সবারই জানা। ২০১১ বিশ্বকাপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় টিম ইন্ডিয়া। মাহেন্দ্র সিং ধনির নেতৃত্বে ২০০৮ থেকে ২০১৫ সময়ে আক্রমণাত্বক চরিত্র পেয়েছিল ইন্ডিয়ান ক্রিকেট সেটি ২০২৩ সালে এসেও টিম ইন্ডিয়ার সাফল্যের মূলমন্ত্র। আর এটি সম্ভব হয়েছে ২০০৭ বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর ক্রিকেট বোর্ডের নেওয়া মহাপরিকল্পনার ফলেই।
২০২৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের নিদারুণ ব্যর্থতার পর আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হতে পারে ইংল্যান্ড এবং ভারতের এমন বদলে যাওয়ার ইতিহাস। টনক কি নড়বে আমাদের ক্রিকেট কর্তাদের? নাকি ভবিষ্যতেও শের ই বাংলা স্টেডিয়ামের প্রাণহীন পিচে সাফল্য খুঁজবে বিসিবি?